রবিবার । মে ১৯, ২০২৪ । । ০১:২৩ এএম

সভ্যতার গ্লানি এবং আমাদের আত্মবোধ

আহমেদ শিরতাজ | নতুনআলো টোয়েন্টিফোর ডটকম
প্রকাশিত: 2020-10-30 01:25:07 BdST হালনাগাদ: 2021-03-24 19:10:06 BdST

Share on

আহমেদ শিরতাজ, কমার্শিয়াল সুপারভাইজার, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

সুন্দর বনের বাঘকে বাঁচাতে হলে পর্যাপ্ত হরিণের প্রয়োজন। আবার বাঘ না থাকলে হরিন এবং বন দুটোই বহিঃশত্রুর আক্রমনে ধ্বংস হত। আর বন ধ্বংস মানে পরিবেশ ধ্বংস;পরিবেশ ধ্বংস মানে পৃথিবী ধ্বংস। সৃষ্টিকর্তার কি অপার লালন পালন ব্যবস্থা।


যদি আপনি বট বৃক্ষ কে বলেন, বট বৃক্ষ তুমি অনেক বড় কিন্তু পাইন গাছের মত নও। ২৪ ঘণ্টা একই কথা বার বার বললেও বট বৃক্ষ কোনদিন ও বিরক্ত হয়ে পাইন গাছ হবেনা। এমনকি আপনি যদি রাগ করে গাছের গোঁড়া পর্যন্ত কেটে ও দেন তবু গোঁড়া থেকে পুনরায় বট বৃক্ষই বের হবে পাইন গাছ বের হবে না। আপনি যদি বেলি ফুলের কাছে কামিনি ফুলের সুগন্ধের প্রশংসা করেন, সে কামিনি ফুল হবেনা। গোলাপ খুব সুন্দর ফুল। তার সৌন্দর্য এবং সুগন্ধে সবায় এতোটায় মুগ্ধ যে তাকে ফুলের রানি বলা হয়। পৃথিবীতে যদি অন্য কোন ফুল না থাকত, সর্বত্র শুধু গোলাপ ফুটত তাহলে কি তাকে ফুলের রানি বলা হত। আবার গোলাপকে ফুলের রানি বলা হলেও কি অন্য ফুলেরা তাদের রূপ রস গন্ধ হারিয়ে ফেলেছে। একটুও নয়। তোমার সৌন্দর্য এবং শ্রেষ্ঠত্ব তোমাকে অন্যের উপর স্থান দিলেও দিতে পারে কিন্তু অন্যকে ধ্বংস করে নয়। ধ্বংসের চেয়ে তুলনা শ্রেষ্ঠ। সর্বত্র তুলনার সুযোগ থাকা দরকার, আমাদের মহান প্রভু এ সুযোগ সবাইকে সমান ভাবে দিয়েছেন। কোন কিছু যত ক্ষুদ্র বা তুচ্ছই হোক তা কে সৃষ্টি করেছেন...আমার, আপনার, আমাদের সকলের পালনকর্তা সেই মহান প্রেমময় প্রভু। কাউকে ঘৃণা বা তুচ্ছ অথবা ধ্বংস করার পূর্বে আপনাকে অবশ্যই এগুলো ভাবতে হবে।


প্রত্যেক বস্তু ও প্রাণীর নিজস্বতা রয়েছে। আপনি যদি আপনার নিজস্বতা তুলে ধরতে চান, তুলে ধরুন। শুধু প্রয়োজন সঠিক সময় এবং সুন্দর উপস্থাপনা । এক্ষেত্রে আপনি ইতর প্রাণীর(অনেক ক্ষেত্রে মানুষ ইতর প্রাণীর চেয়ে ও নিচে নেমে যায়) ভাষা ও ভঙ্গিমা ব্যাবহার করবেন না মহান ব্যক্তিদের অনুসরন করবেন তা আপনাকে নির্ধারণ করতে হবে। প্রকৃতির দিকে তাকান, দেখুন সেখানে সব কিছু কিভাবে প্রকাশিত হয়ে আছে। সেই ভাবে নিজেকে তুলে ধরুন। নিজের স্বার্থে সমাজ এবং রাষ্ট্রের বৃহৎ কল্যাণ ধুলোয় মিশিয়ে এ জগতে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। পূর্বে এবং এখনও যারা এ রাস্তায় হাঁটছে, দরিদ্র দেশ গুলোর অভ্যন্তরে ঢুকছে তাদের শেষ স্বম্বল টুকু কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে, সমাজে রাষ্ট্রে যত্রতত্র অশান্তির আগুন লাগাচ্ছে, অশিক্ষিত মানুষের মতো দ্বন্দ-সঙ্ঘাতে অন্যের চরিত্র হনন করছে তা আর যায় হোক উন্নত বিশ্ব প্রমান করেনা। হিংস্র পশুর শ্রেষ্ঠত্ব বহন করে। কৌশলে সমাজে ধর্মান্ধতা ছড়িয়ে, জঙ্গি গোষ্ঠী বানিয়ে একের পর এক সভ্যতা হরন করছ। অথচ তোমরায় আবার হেরিডিটির কথা বলে বিলুপ্ত এবং বিলুপ্ত প্রায় জীব, ভাষা এবং প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন উদ্ধারের জন্য গবেষণা করছ। পুরাতন (যা অন্যের) যদি অপছন্দের হবে তবে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সভ্যতার নিকৃষ্ট বিলাসিতা। যা বিলুপ্ত, হয়েছে যা নিকৃষ্ট তাতো বিলুপ্ত হবেই তা নিয়ে কেন ঘাটাঘাটি করছ। মানুষ যতদিন আমি ছাড়া অন্যকে পছন্দ করতে পারবে না, যতদিন নিজের সম্রাজ্যবাদি আমিত্বকে বর্জন করতে পারবে না ততদিন এ সমাজে উচুনিচু ভেদাভেদ রয়েই যাবে। এই বিশ্বজগতের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায়- বৈচিত্রময়তায়, ব্যাপকতায়, প্রাচুর্যতায় । এখানে প্রতিটি প্রজাতি এত অধিক পরিমাণে বিরাজমান যে, কোন কিছুতেই আমরা হতাশ হইনা। জীবনের লক্ষ লক্ষ সম্ভাবনার কোন না কোন একটি সৌন্দর্যে আমরা মুক্তি লাভ করি, মুগ্ধ হই।


যারা মূর্খের মতো মানুষের অন্তর নিয়ে, আবেগ নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে ঠাট্টা করে, অপমান করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তারা যত বড় শক্তিশালীই হোক, শিক্ষিত-সজ্জন ব্যক্তিই হোক- কল্যাণময় মানুষ কখনও নয়। সেই ব্যক্তি কোন একটা দেশের শাসক হতে পারেন, পাঁচ-দশ বছরের জন্য নির্বাচিত হতে পারেন, কিন্তু যিনি হাজার বছরেরও অধিক কাল ধরে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অন্তরের অনুপ্রেরণার ধারক, তাঁকে নিয়ে কথা বলার পূর্বে অবশ্যই চিন্তা ভাবনা করা উচিৎ। সৌন্দর্য দিয়ে সৌন্দর্য খর্ব করা যায়, বিকৃত করে নয়। কাউকে ছোট করতে হলে তোমাকে তার চেয়ে বড় হতে হবে। ভালোবাসার ঘর, বিশ্বাসে সাজানো হৃদয়, তা যত নড়বড়ে হোক তার শিকড় বহু দূরে প্রোত্থিত আছে।


বর্তমান ভোগবাদী এ সমাজে আমাদের মননে চেতনায় আমরা যা ধারন করছি তা প্রায় একই। আপনারা নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন। অন্যের ধর্ম ও সংস্কৃতি বিষয়ে আপনার অন্তরে কি ধারনা লালন করছেন। কতোটুকু সহমর্মিতা আপনি লালন করছেন। শ্রদ্ধা বোধ আপনি লালন করছেন। এই ঘৃণিত বোধ কাজ করেছে ফ্রান্সে। ওখানে মুসলমান ১০%। অন্যরা ৯০%। ঐ দেশের সংবাদপত্র এবং সরকার প্রধান ৯০% কে খুশি করেছেন। যদি মুসলমান তথা ফ্রান্সের সব মানুষ সব ধর্মের ও সংস্কৃতির প্রতি সহমর্মীতা ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করতে পারত তাহলে কোন অধার্মিক শাসক টিকে থাকতে পারত না। রাজনীতিতে এখন ধর্মের সুড়সুড়ি টনিকের মতো কাজ করে। প্রায় সর্বত্র এটা বিরাজমান। পৃথিবীর সর্বত্র এখন ভাঁড় আর ধান্দাবাজ রাষ্ট্রপ্রাধানে ভরে গেছে। বিশ্বজনীন চেতনার অধিকারির সংখ্যা খুব কম। ক্ষমতায় থাকার জন্য এরা যেমন অন্যের পাছার কাপড় টেনে খোলে তেমনি নিজের নগ্নতাও উপভোগ্য করে তোলে। আমরাও তাদের এই বেহায়াপনায় দারুণ মুগ্ধ।


যতদিন এ সমাজ ফুল ও পাখির সৌন্দর্য হৃদয়ে ধারন না করবে, কিট-পতঙ্গের জাদুকরি প্রযুক্তি আয়ত্বে না আনবে, জোছনায় মুগ্ধ হবে, নীলাকাশ ও মেঘের সৌন্দর্যে নিজেকে বিস্তৃত না করবে (এগুলো সব সৃষ্টিকর্তার তৈরি) ততদিন এ সমাজ আমদেরকে ঘৃণার পথ, ধ্বংসের পথ থেকে দূরে সরাতে পারবেনা।


হজরত মুহাম্মদ (সঃ) তো এক বিশাল বৈভব, ব্যপক সভ্যতা, উৎকৃষ্ট মানবতার নির্মল উদাহরণ। কোনও উন্মাদ যদি তাঁকে (সম্মান প্রদর্শনপূর্বক) গালি দেয়, ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করে এটা তার নীচতা, ঘৃণিত বোধের বিষ বাস্প। এতে কেউ ধ্বংস হবেনা, ঐ ব্যক্তি ছাড়া। ঐ ঘৃণ্য ব্যক্তিকে বিশ্বজনীন করার কোন দরকার নেই। ও অন্ধ গলিতে মরে পচে দুর্গন্ধ ছড়াক। আমাদের হৃদয়ের সৌন্দর্য এবং চেতনার সৌরভে তা দূরে সরিয়ে রাখব। ওকে ঘাটাঘাটি করলে আপনি যেমন দুষিত হবেন, এ সমাজও দুষিত হবে।


বহুবছর আগে শেখ সাদি লিখেছিলেন, যা সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন-
“কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায়
তায় বলে কি কুকুরকে কামড়ানো মানুষে শোভা পায়”।


যে ব্যক্তি ব্যঙ্গ চিত্র এঁকেছে, যে সংবাদপত্র তা ছেপেছে, তার পক্ষে যারা সাফাই গেয়েছে তারা যেমন কুকর্ম করেছে, তেমনি তাঁকে যে হত্যা করেছে তাও খুব উন্নত মানের কর্ম হয়েছে বলা যাবেনা। নিশ্চয় শেখ সাদি বা উন্নত বোধের কেউ এ ধরণের কাজ করবে না। আমরা কাকে অনুসরণ করব। মহানবী মক্কা বিজয়ের পর তার প্রিয় সাহাবীদের যারা হত্যা করেছিল, তাদের সকলকে ক্ষমা করেছিলেন। হীরাকে কি ময়লায় ফেললে তা নষ্ট হয়। কেউ যদি নিচু মনের পরিচয় দেয় আপনাকে ও নিচে নামতে হবে এটা সঠিক নয়। তাহলে আপনি যে অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, তা প্রমান করবেন কিভাবে। কোন মানুষের নীচতায় আপনি যদি মানুষ হিসাবে লজ্জিত না হন- এই ভেবে যে মানুষ কিনা আশরাফুল মাখলুকাত। তার বোধের অনুন্নয়ন আপনাকে হিংস্র না করে যদি লালন পালনকারী করত তবে আরও ভালো হত। কেননা ঐ নিচু বোধের মানুষটি অন্তত কোন এক সময় উন্নত বোধের মানুষ হতে পারত। নিজেকে সংশোধন করতে পারত। স্রষ্টা যে সুযোগ সবায় কে দিয়েছেন আপনি আত্মগ্লানিতে তা ধ্বংস করতে পারেন না। আপনার তুলনায় স্রষ্টার প্রযুক্তি অনেক উন্নত। তার সৃজনশীলতা কারো প্রশংসার পরোয়া করে না। মানুষ হিসেবে আমাদের অন্তর, চেতনাবোধ স্রষ্টাকে অনুসরণ করবে এটাই কাম্য।

 

আমাদের তুলনায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতিবাদের ভাষা অনেক বেশি শক্তিশালী । তিনি মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু ধ্বংস ও সৃষ্টি ও করতে পারেন। এত ক্ষমতা থাকার পরও তিনি যদি প্রিয় নবীর অপমানকারী বা তাঁর আদেশ লঙ্ঘনকারীর ধ্বংস না করে থাকতে পারেন। তবে আমাদের ও অপেক্ষা করা উচিৎ। একমাত্র আল্লায় শ্রেষ্ঠ বিচারক। আমরা যদি বিশ্বাসী হই তবে ধৈর্যশীলতা ও সৌন্দর্য নিয়ে স্থির হব। সব সমস্যার সমাধান অবশ্যই হবে। আমাদেরকে শুধু আমাদের সৌন্দর্য ও মহত্ব বিকশিত করতে হবে। আমদেরকে অবশ্যই প্রতিবাদী হতে হবে। মহৎ সৎ শ্রেষ্ঠ প্রতিবাদী হতে হবে। মহান হতে হবে। প্রতিবাদের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি আয়ত্বে নিতে হবে। পুরাতন কে ছেঁটে মহাপুরুষেরা যেভাবে নতুন নিয়ম প্রবর্তন করেছেন তা বুঝতে হবে। আমাদের নবী আসার পূর্বে বহুশত বছর ধরে কাবা ঘরে তিন শতাধিক দেব দেবী একত্রে অবস্থান করেছিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের ধ্বংস করে দেননি। মহানবীর মাধ্যমে তাদের সংশোধনের সুযোগ করে দিয়েছেন। অতএব কোন কিছুর বিরোধিতা করার পূর্বে, ঘৃণা করার পূর্বে অবশ্যই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে, চেষ্টা চালাতে হবে। আমাদের অন্তর থেকে পুরাতনকে দূর করা এত সহজ নয়। তাঁর জন্য সাধনা প্রয়োজন। একমাত্র তখনি আমাদের সৌন্দর্য এবং মহত্ব আমাদেরকে পুরাতন নিয়মের উপর স্থান দেবে।


লেখক: আহমেদ শিরতাজ, কমার্শিয়াল সুপারভাইজার, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স (সিলেট)



  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত
  • নির্বাচিত